বেইলি রোডের ভবনটিতে বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট, সিঁড়িতে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার
বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামে ভবনটিতে আগুন লাগে।
রাজধানীর বেইলি রোডে সাত তলা একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর চলছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নিহত ৪৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। এখনো পর্যন্ত সাত জনের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪ জন, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ১০ জন এবং পুলিশ হাসপাতালে এক জন মারা গেছে।
“আমরা ইতিমধ্যে ২৪টি লাশ হস্তান্তর করেছি। ২১ জন এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্বজনরা আসছেন। আমাদের কাজ চলমান আছে।"
মি. রহমান জানান, আগুনের ঘটনা কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জনের মতো আহত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এগুলো হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল।
তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে আশেপাশের আরো অনেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতেও চলে গেছেন বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এর আগে ঘটনাস্থল থেকে ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
কী ঘটেছিল
বৃহস্পতিবার রাত দশটার দিকে গ্রিন কজি কটেজ নামে একটি ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর খুব অল্প সময়েই পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ভবনটির নিচের দিকে আগুন লাগে এবং পড়ে তা উপরে ছড়িয়ে পড়ে।
নিচতলায় আগুন লাগার কারণে ভবনটির উপরের তলাগুলোতে আটকে পড়েন অনেকে।
প্রাণ বাঁচানোর জন্য উপর থেকে মানুষ লাফিয়ে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেও পারেনি অনেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ জানিয়েছেন, দুই বা তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে অনেকে হাত পা ভেঙ্গে আহত হয়েছেন। তবে তারা বেঁচে গেছেন।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়িটি ‘অগ্নি চুল্লির’ মতো হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেনি।
সিঁড়ি দিয়ে এক সাথে তিন জনের বেশি যাতায়াত করা যেতো না বলেও জানা গেছে।।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, যারা মারা গেছে তাদের বেশিরভাগ আগুনে পুড়ে নয়, বরং তারা আসলে ধোয়ার কারণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর আগে তারা অচেতন হয়ে পড়েছিল।
ভবনটির আগুন নেভানোর তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
তবে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়েনি।
বেইলি রোড এলাকার সকালের চিত্র।
সকালের অবস্থা কী?
বিবিসির সংবাদদাতা নাগিব বাহার সকালে ঘটনাস্থল থেকে জানান, গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থল তদন্ত করে দেখছেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও রয়েছেন।
শুক্রবার সকালে ভবনের সামনের রাস্তা খুলে দেয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে ছোটখাটো জটলা রয়েছে।
আগুনে ভবনের সামনের অংশ পুরোপুরি পুড়ে গেছে।
সকালে ঘটনাস্থলে থাকা অনলাইনে খাবার অর্ডার দেয়ার একটি সার্ভিসের কর্মীরা জানান, আসরের নামাজের পর তারা এখানেই এসে ভিড় করেন কারণ বেশিরভাগ অর্ডার এখানেই থাকে। কারণ আগুন লাগা ভবনটিতে মূলত খাবারের দোকান ছিল। সাততলা ভবনের ছাদেও একটা রেস্টুরেন্ট ছিল।
এছাড়া একটি পোশাকের দোকান ও কয়েকটি মোবাইলের দোকানও ছিল বলে জানা যায়।
স্থানীয়দের অনেকে জানান, ২৯শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে 'কাচ্চি ভাই' নামে একটি রেস্তোরায় ছাড় থাকায় মানুষের ভিড় বেশি ছিল।
তবে বৃহস্পতিবার ওই এলাকার মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ না থাকলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারতো বলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তারা।
সকালে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আবারো প্রবেশ করেন পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে। আরো কোন মরদেহ ভেতরে আছে কিনা তা খুঁজতে ভেতরে প্রবেশ করেন তারা।
ভোরে স্বজনদের খোঁজে পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে ভিড় করেছেন অনেকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই ভিড় আরো বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০ টার দিকে আগুন লাগে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
“আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে কারণ এটা একটা বড় দুর্ঘটনা।”
তবে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। এছাড়া আগুন লাগার সময় ভবনটিতে কত জন উপস্থিত ছিলেন সেটিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে এই আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত দেড়টার পর আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ফায়ার সার্ভিস ভেতরে ঢুকে মরদেহ উদ্ধার করতে শুরু করে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এই ভবনে আগুন নির্বাপণের তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানান, প্রথমে আগুন ছোট ছিল। পরে সেটি বড় হয়। এই ভবনের একটিমাত্র সিঁড়ি। প্রতিটি ফ্লোরে একটি করে সিলিন্ডার ছিল।
২০১০ সালে ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে থেকে আগুন লেগে ১২৪ জন মারা গিয়েছিল। আর ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে মারা গিয়েছিল ৭১ ন। একই বছর মার্চে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জন মারা যায়।
ঘটনাস্থল থেকে জীবিত অবস্থায় অনেককে উদ্ধার করা হয়।
হাসপাতালের চিত্র কী?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আহতদের বেশিরভাগ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ১৪ জন এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আট জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যারা আহত রয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
কারণ অনেকের দেহের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অনেকের শ্বাসনালীও পুড়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে।
হাসপাতালে ভিড় করেছেন স্বজনরা। সকালেও কয়েকজনের মরদেহ নিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে তিনটি মরদেহ এবং অচেতন অবস্থায় আরো ৩৩ জনকে আনা হয়।
পরে চিকিৎসকরা জানান, এদের মধ্যে বেশিরভাগকেই মৃত্যু অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আর হাসপাতালে আনার পরও মারা যান অনেকে।
জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, নিহতদের দাফনের খরচের জন্য ২৫ হাজার টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কেউই এই তহবিল থেকে খরচ নিতে আগ্রহ দেখাননি বলেও তিনি জানান।