বিশ্ব বাজারে কি এই বছর তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম কমবে?

Ahmed Ihtisham
0

 


বিশ্ব বাজারে কি এই বছর তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম কমবে?

তেল

ছবির উৎস

ছবির ক্যাপশান,

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে তেলের বাজারে

  • Author,৩ মার্চ,  ২০২৪

তেল বা গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম সব দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

কারখানা সচল রাখা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ, মানুষ ও পণ্য পরিবহন এবং ঘরবাড়ি উষ্ণ বা শীতল করার জন্য উন্নত সমাজে আমাদের প্রচুর পরিমাণে জ্বালানির প্রয়োজন হয়।

এক্ষেত্রে জ্বালানির দাম বাড়লে আমাদের জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে যায়।

এই বিষয়টি দুই বছর আগে আরও স্পষ্টভাবে নজরে আসে যখন করোনা মহামারী এবং রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করার পর জ্বালানির খরচ বাড়িয়েছিল।

এটি সারা বিশ্বেই মুদ্রাস্ফীতির নতুন ঢেউ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।

আর এই মুদ্রাস্ফীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো সুদের হার বাড়িয়েছে, যার ফলে ব্যবসা থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবন পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই ঋণের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।

এখন আমরা মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কার সেই প্রভাব টের পাচ্ছি।

যুক্তরাজ্যে ভোক্তাদের জন্য এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম একটি নির্দিষ্ট সীমায় রাখা করা হয়েছে এবং গৃহস্থালীতে এগুলোর ব্যয় এখন দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

তারপরও দেখা যাচ্ছে, এটি অতীতের যে কোন সময়ে চেয়ে বেশি।

আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে দেখা যাবে, জ্বালানির দাম খুব সস্তা হলে সেটি আরও দক্ষ ও পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিবে।

ফলে সেটি আমাদেরকে উচ্চ কার্বন নির্গমনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী এক বছরে জ্বালানির দাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

হুথি

ছবির উৎস

ছবির ক্যাপশান,

লোহিত সাগরে অনেক মালবাহী জাহাজ এখন হামলার শিকার হচ্ছে

জ্বালানি তেলের খরচ

২০২২ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি দাম সর্বোচ্চ ১৩৯ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল এবং গড় প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার করে পড়েছিল।

সে হিসেবে অবশ্য গত বছর জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কম ছিল।

২০২৩ সালে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ ৯৮ মার্কিন ডলার হয়েছিল, যা গড়ে ৮৩ মার্কিন ডলার করে পড়েছে।

তেলের দাম বাড়ানোর জন্য জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রভাবশালী সংগঠন ওপেকের পক্ষ নানান সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও গতবছর দাম এমনটিই দেখা গেছে।

তাছাড়া ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা তো ছিলোই।

অন্যদিকে, ইন্ডাস্ট্রি নিউজ সার্ভিস এনার্জি ইন্টেলিজেন্সের এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, আগামী এক বছরে তেলের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় এগারো লাখ ব্যারেল বৃদ্ধি পাবে।

তবে তারা মনে করছে যে, ওপেকভূক্ত দেশগুলোর বাইরে থেকে তেলের যে সরবরাহ পাওয়া যাবে, সেটি দিয়ে এই বাড়তি চাহিদা মেটানো যাবে।

তাতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, এবছর জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে।

যদিও ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) সতর্ক করেছে যে, “মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা তেলের বাজারে সংকট তৈরি করছে।

কেননা, সমুদ্র পথে বিশ্বে যত তেল পরিবহন করা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই ওই পথ দিয়ে যায়"।

উইন্ড টারবাইন এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় উৎস

ছবির উৎস

ছবির ক্যাপশান,

উইন্ড টারবাইন এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির বড় উৎস

“সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর প্রায় ৮০ মার্কিন ডলারে প্রতিব্যারেল তেল কেনা যাবে। তবে এক্ষেত্রে একটি বড় কিন্তু রয়েছে”, বলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিস্ট্যাড এনার্জির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ লিওন।

“ধরা যাক, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এক্ষেত্রে আমার কাছে প্রধান প্রশ্ন হলো- সৌদি আরব কী করবে?”

আইইএ’র হিসেবে, সৌদি আরব হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রপ্তানিকারক দেশ, যাদের প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

“আমরা মনে করি না যে, সৌদি আরব প্রতি ব্যারেল তেলের দাম দেড়শ’ মার্কিন ডলারের উপরে নিয়ে যেতে চাইবে বা বাড়ানোর অনুমতি দেবে। সেক্ষেত্রে দামও খুব বেশি বাড়বে না। তেমনটি ঘটলে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম হয়তো ৯০ থেকে ৯৫ মার্কিন ডলার পড়তে পারে", বলেন মি. লিওন।

আবার তেলের দাম কমেও যেতে পারে। যদি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয় এবং তেলের চাহিদা কমে যায়, সেক্ষেত্রে ওপেকের সদস্যরা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে। তবে সেই সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন মি. লিওন।

“আমি মনে করি না যে, ওপেক প্লাসের এই নিম্নগামী চাপ সামলানোর মতো যথেষ্ট শক্তি বা সংহতি আছে," বলেন তিনি।

সেক্ষেত্রে, ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ৭০ মার্কির ডলারেও নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন মি. লিওন।

গ্যাস

ছবির উৎস,

ছবির ক্যাপশান,

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল

প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম

এবছর গ্যাসের দাম বাড়বে-নাকি কমবে, সেটি অনেকাংশেই ইউরোপের দেশগুলোর ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

গত দুই বছরে সেখানকার বাজারে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

আগে ইউরোপের মোট আমদানিকৃত গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করতো রাশিয়া, যেগুলো মূলত পাইপলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হতো।

কিন্তু দেশেটি ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরে গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়। অন্যদিকে, দাম বেড়ে যায়, যা সারা বিশ্বেই গ্যাসের দামের উপর প্রভাব ফেলেছে।

কারণ রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলো গ্যাসের নতুন সরবরাহকারীর খোঁজ শুরু করে।

এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কাতারের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গাস (এলএনজি) এখন রাশিয়ার বাজার ধরে ফেলেছে।

তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন কোনভাবেই গ্যাসের সংকট তৈরি না হয়। তাছাড়া গ্যাসের চাহিদাও কিছুটা কমেছে।

“আমরা সত্যিকিার অর্থেই ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পরে সেটার একটা ব্যবস্থা আমরা করেছি। এখন আমরা রাশিয়ার পাইপলাইন গ্যাস ছাড়াই বাঁচাতে শিখে গেছি”, ব্যাখ্যা করে বলেন অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট অব এনার্জি স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. জ্যাক শার্পলস।

“ইউরোপ এখন এলএনজি আমদানির ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং চাহিদা কমিয়েছে। বাজারও সেটি মানিয়ে নিয়েছে," বলেন তিনি।

কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, গ্যাসের দাম স্থিতিশীল থাকবে।

জাহাজ

ছবির উৎস

ছবির ক্যাপশান,

ইউরোপ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কাতারের কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করছে

“এখন আমাদের বাজার কেবল ভারসাম্যপূর্ণই নয়, বরং দারুণভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কারণ আমরা কোন সংকটজনক পরিস্থিতিতে যেমন নেই, তেমনি আমাদের উদ্বৃত্ত গ্যাসও নেই,” বলেন ড. শার্পলস।

এটার মানে ঝুঁকি এখনও রয়েছে। কারণ যদি গ্যাসের সরবরাহে কোন সমস্যা হয় বা হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বেড়ে যাতে পারে।

লোহিত সাগরে সৃষ্ট উত্তেজনা ইতিমধ্যেই এলএনজি আমদানির উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

কাতার ও ইউরোপের মধ্যে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী মালবাহী জাহাজগুলো আগে সাধারণত মিশরের সুয়েজ খাল ব্যবহার করে চলাচল করতো।

কিন্তু ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর এখন জাহাজগুলোকে আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূল ঘুরে যেতে হচ্ছে। ফলে সময় এবং খরচ দু’টোই বেশি লাগছে।

অবশ্য এখন অবধি এটি বিশ্ববাজারে গ্যাসের দামের উপর সামান্যই প্রভাব ফেলেছে বলে দেখা যাচ্ছে। কারণ বাজারে এখনও প্রচুর এলএনজি’র সরবরাহ রয়েছে।

কিন্তু সামনে যদি চাহিদা বাড়তে থাকে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রেও চাপ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যও বেড়ে যেতে পারে।

বিদ্যুৎ

ছবির উৎস,

ছবির ক্যাপশান,

গ্যাসের দাম অনেক সময় বিদ্যুতের দামের উপর প্রভাব ফেলে

বিদ্যুতের মূল্য

বিদ্যুতের দামের ব্যাপারে পূর্বাভাস দেওয়া বেশ কঠিন কাজ।

কারণ এটি কীভাবে উৎপন্ন হচ্ছে, উৎপাদনে কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে, কতটা চাহিদা রয়েছে এবং আবহাওয়া কীভাবে উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে- এরকম অসংখ্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে।

আপনি কোথায় আছেন, সেটির উপর নির্ভর করে যে আপনি কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন।

এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেল, পারমাণবিক জ্বালানি, জলবিদ্যুৎ, বায়ু ও জোয়ারের শক্তি, সৌর এবং এমনকি ভূ-পৃষ্ঠের তাপও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে একদেশ থেকে অন্যদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানিও করা যেতে পারে।

বিদ্যুতের পাইকারি বাজার, যেখানে সরবরাহকারী এবং ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের নোটিশে বিদ্যুৎ কিনে থাকে, সেখানে বিদ্যুতের চাহিদার পরিমাণের উপর ভিত্তি করে মূলত: দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে যখন বিদ্যতের চাহিদা বাড়ে, তখন সেটি মেটাতে পারমাণবিক ও নবায়নযোগ্য শক্তির বাইরে গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দেখা যায়।

এতে বিদ্যুতের দাম এবং গ্যাসের দামের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি হয়। অর্থাৎ যদি গ্যাসের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।

রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে মূলত এই কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর গ্যাসের দাম বেড়েছে, ফলে বিদ্যুতের দামও বেড়ে গেছে।

আইইএ’এর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে বিদ্যুতের দামে নতুন রেকর্ড তৈরি হওয়ার পর গত বছর বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে পাইকারি বাজারে বিদ্যুতের দাম কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমতে দেখা গেছে, এশিয়া এবং ইউরোপে। যদিও অঞ্চল গুলোতে বিদ্যুতের দাম করোনা মহামারির আগের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল।

তবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোক, কিংবা গৃহস্থালী, বিদ্যুতের বিল কত আসবে, সেটি কেবল পাইকারি বাজারের উপর নির্ভর করে না।

বরং বিদ্যুতের বন্টন ব্যয়, শুল্ক, কর এবং সরবরাহকারীর মুনাফা ইত্যাদি অনেক বিষয়ই এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে থাকে।

দেশভেদে এগুলো আবার ভিন্ন ভিন্ন হতেও দেখা যায়।

Post a Comment

0 Comments
Post a Comment (0)
To Top